বর্তমান যান্ত্রিক বিশ্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ফুয়েল বা জ্বালানির ভূমিকা অপরিহার্য। আজকের এই আধুনিক জীবন যাপন যন্ত্র ছাড়া ভাবাই যায় না, তেমনি জ্বালানি ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতাও অসম্ভব। গোটা বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার প্রায় আশি ভাগেরও বেশি যোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম-জ্বালানি; বিশেষ করে পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস ভিত্তিক জ্বালানি। বলা যায় জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর আমরা আজ অনেকাংশে নির্ভরশীল। অন্যদিকে এই চরম নির্ভরশীলতাই আমাদের ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। গোটা বিশ্ব আজ জীবাশ্ম-জ্বালানি নির্ভরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন, যার পেছনে রয়েছে মুলত তিনটি কারণ; অনিশ্চিত জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ দূষণ এবং তেল ভিত্তিক ভূ-রাজনীতি।
সারা বিশ্বে প্রতিদিন বাড়ছে জনসংখ্যা, বাড়ছে যানবাহন আর শিল্প-কারখানা। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদা। ২০০৭ সালের এক হিসেব অনুযায়ী বিশ্বে মোট যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৮০৬ মিলিয়ন, যা ২০৩০ সালের দিকে ১.৩ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালের দিকে ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। ২০০৮ সালে পেট্রোলিয়াম এবং অন্যান্য তরল জ্বালানির ব্যাবহার ছিল প্রতিদিন ৮৫.৭ মিলিয়ন ব্যারেল, যা ২০৩৫ সালের দিকে ১১২.২ মিলিয়ন ব্যারেলে পৌঁছাবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত সারা বিশ্বে সব ধরনের জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যাবহার ছিল শূন্যের কোটায়, যা ক্রমবর্ধমান ভাবে বেড়ে গত শতকের শেষ দিকে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭,৫০০ মিলিয়ন টন প্রাকৃতিক গ্যাস, ৬,০০০ মিলিয়ন টন পেট্রোলিয়াম তেল এবং ২,০০০ মিলিয়ন টন কয়লা। অন্যদিকে জীবাশ্ম-জ্বালানির সঞ্চিত ভান্ডার সীমিত ও অ-নবায়নযোগ্য, এবং ধারনা করা হচ্ছে আগামী ৪০-৫০ বছরের মধ্যে এই মজুদ নিঃশেষ হয়ে যাবে।
শিল্প-কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের জন্য পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণের কারণে এক-তৃতীয়াংশ অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ইউনিভার্সিটি অব বার্মিংহাম, ইউনিভার্সিটি অব লিচেস্টার এবং ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন মিলিতভাবে গবেষণাটি পরিচালনা করেন।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে পাঁচটির মধ্যে একটি মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারে সৃষ্ট বায়ুদূষণ দায়ী। গবেষণায় শক্তি উৎপাদন, শিল্প কারখানা ও পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতে জ্বালানি ব্যবহারের হার তুলে ধরা হয়। নতুন এই গবেষণায় ২০১২ সালের বায়ুদূষণ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত ব্যবহৃত হয়েছে। সেবছর বায়ুদূষণে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৯২ হাজার ৮১ জন মৃত্যুবরণ করে। তাদের মধ্যে ২ লাখ ৫২ হাজার ৯ শত ২৭ জনের মৃত্যু বায়ুতে উপস্থিত জীবাশ্ম জ্বালানি কণার কারণে হয়েছিল। অর্থাৎ প্রায় ৩৬ শতাংশ মৃত্যুর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি দায়ী।
শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় চীনের নাম আছে প্রথমে। দেশটিতে জ্বালানি সৃষ্ট বায়ুদূষণে ৪০.২ শতাংশ মৃত্যু হয়ে থাকে। এই তালিকায় ৩০.৭ শতাংশ মৃত্যুহার নিয়ে ভারত আছে তৃতীয় অবস্থানে। দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়া আছে যথাক্রমে; চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে।
বাংলাদেশে জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য উৎসের কারণে বায়ুদূষণে মৃত্যুহার বেশ উচ্চ। সকল মৃত্যুর জন্যই মানুষের কার্যক্রম দায়ী। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস এবং অন্যান্য বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে এই অবাঞ্ছিত মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
ঢাকার রাস্তায় দুই স্ট্রোক বিশিষ্ট তিন চাকার বেবিট্যাক্সি নিষিদ্ধ করে বায়ুদূষণ ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো গিয়েছিল। একইভাবে যদি বিভিন্ন কারখানায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা যায় তাহলে মৃতের সংখ্যাও উল্লেখজনকভাবে কমানো সম্ভব। কোভিড-১৯ চলাকালীন সময়ে প্রথম তিন মাসে বায়ুদূষণ পরিস্থিতি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুধরে গিয়েছিল। কেবলমাত্র প্রকৃতিতে মানুষের হস্তক্ষেপ কমার ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। একমাত্র নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমেই জীবশ্ম-জ্বালানি জনিত মৃত্যু কমানো সম্ভব। ১৯৯৫ সালে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ছিল ৫৪.৪ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩.৮ শতাংশে গিয়ে পৌঁছে। এসময় গড় বার্ষিক জ্বালানি বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংক বলেছে, জলবায়ু সম্পর্কিত প্যারিস চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো বৈশ্বিক তাপমাত্রার গড় বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা। কিন্তু এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সাল নাগাদ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার যে পর্যায়ে সীমিত রাখা দরকার, বর্তমানে বিশ্ব তার চেয়ে ১২০ শতাংশ বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের পথে রয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু কর্মসূচির গবেষকরা এমনটাই জানিয়েছেন। অবশ্য আশার কথা হলো, কার্বন নিঃসরণ কমানো ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি শ্লথ করার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব কমাতে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে জলবায়ুতে যে পরিবর্তন আসবে, তা ২০৩০ সাল নাগাদ ১০ কোটির বেশি মানুষকে দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেবে।
বাংলাদেশ এমনিতেই বিশ্ব পরিবেশ দূষণের অন্যতম শিকার। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির আরেকটি কারণ জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তোলন ও ব্যবহার। জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের বিশাল এলাকা আজ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় অতিরিক্ত জ্বালানি তেল ব্যবহার, পরিবেশকে আরো দূষিত করতে পারে। কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয় কিন্তু এর বিপদের ভাগটা বাংলাদেশকেই অনেক বেশি নিতে হচ্ছে। বৈশ্বিক ঊষ্ণতার ফলে সমুদ্র উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, এর ফলে বাংলাদেশের এক-পঞ্চমাংশ এলাকা সাগরে চলে যাওয়া, এইসব আশঙ্কার কথা, আমরা বেশ কয়েক বছর যাবৎ শুনে আসছি। কিন্তু এ পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, অর্থাৎ পরিবেশ দূষণের শিকার দেশগুলো আরও ধ্বংসের দিকে এগুচ্ছে।
বর্তমান সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে আলোচিত ও ভয়ংকর বিষয় হলো পরমাণু শক্তি। পরমাণুর নিউক্লিয়াস কে ভেঙ্গে বা বিভাজন করে যে শক্তি পাওয়া যায় তাকেই পারমানবিক শক্তি বলে। পারমানবিক শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন বহিঃস্থ (এক্সটার্নালিজ) ব্যয় সৃষ্টি হয় যেগুলোর সামাজিক ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক অংকের। পারমানবিক দুর্ঘটনার ফলে ব্যাপক মাত্রার ক্ষতি হয় (চেরনোবিল ও ফুকুশিয়া পারমানবিক দুর্ঘটনা), সন্ত্রাসী হামলা ও নাশকতাজনিত ঝুঁকি থাকে, পারমানবিক স্থাপনায় সম্ভাব্য চুরি, পারমানবিক বর্জ্য নিরাপদে স্থানান্তর করা জনিত সমস্যা। যুদ্ধে পারমানবিক বোমা প্রয়োগ করলে বা পারমানবিক স্থাপনায় বোমা নিক্ষেপ করলে তেজস্ক্রিয়তা চারিদিকে বিপদজনক ভাবে ছড়িয়ে পড়বে।
সুতরাং একটি টেকসই, অর্থনৈতিক ভাবে কার্যকরী এবং পরিবেশ-বান্ধব বিকল্প জ্বালানির উৎস খুঁজে বের করা আমাদের শিল্প এবং ভোক্তা সমাজের সময়ের দাবি। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌর শক্তি ও জৈব-জ্বালানি (বায়োফুয়েল) সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সম্ভাবনাময়। এই সম্ভাবনা বা সুবিধাগুলোকে তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা যায়; পরিবেশগত, জালানি নিরাপত্তা বিষয়ক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। সৌর শক্তি ও জৈব-জ্বালানির ব্যাবহার বায়ু-দুষণ এবং গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। অধিকন্তু, যেহেতু বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য (কৃষিজাত ও পৌর) থেকেও জৈব-জ্বালানি তৈরি করা যায়, সেহেতু এই ধরনের জ্বালানির উৎপাদন সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করবে। অন্যদিকে একটি কার্যকর জালানি নিরাপত্তার উৎস হতে পারে জৈব-জ্বালানি, কারণ এই জ্বালানি স্থানীয় উৎস থেকে স্থানীয় ভাবে উৎপাদন, পরিবহণ ও বিপণন করা যায়। অর্থনৈতিক ভাবেও জৈব-জ্বালানি বিভিন্ন কারনে প্রতিশ্রুতিশীল। মোটামুটি স্থিতিশীল মূল্যের জৈব-জ্বালানি একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা যা আন্তর্জাতিকভাবে অধিকতর প্রতিযোগিতামূলক। সর্বোপরি, এই ধরনের জ্বালানি ব্যবস্থা গ্রামীন ও কৃষি উন্নয়ন, এবং নতুন কর্ম সৃষ্টিতে ভুমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
জৈব-জ্বালানির মধ্যে বায়ো-ইথানল, বায়ো-মিথানল, বায়ো-বিউটানল, বায়ো-ডিজেল, বায়োগ্যাস এবং বায়ো-হাইড্রোজেন অন্যতম। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হল বায়ো-ইথানল, যা ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে শিল্প-পরিসরে উৎপাদন এবং ব্যবহার চালু হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হল ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডা এবং ইউরোপের কিছু দেশ।
মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, দীর্ঘদিন আগে মানুষ জীবাশ্ম জ্বালানি সম্পর্কে তেমন কিছু জানত না। এর পরও তখনকার মানুষ কিছু জীবাশ্ব জ্বালানি ব্যবহার করত। চতুর্দশ শতাব্দীর ব্রিটেনে কয়লার কিছু ব্যবহার দেখা যায়, যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে বৃদ্ধি পায়। বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিশ্বে অধিকাংশ মালপত্র বহন ও বাণিজ্য ছিল নৌপথভিত্তিক। আর সপ্তাদশ শতাব্দীতে বায়ুপ্রবাহ ও পানির স্রোত ব্যবহার করে কিছু কারখানা গড়ে ওঠে, যা একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেও দেখা গেছে।
বিজ্ঞানীদের মতে, জীবাশ্ম জ্বালানিবিহীন পৃথিবীর কথা কল্পনা করতে গেলে প্রথমেই বিকল্প জ্বালানি হিসেবে বিদ্যুৎ শক্তির কথা ভাবতে হবে। বিদ্যুৎ শক্তিই হতে পারে জীবাশ্ম জ্বালানির একমাত্র বিকল্প। আর বিদ্যুৎ তৈরির জন্য ব্যবহার হতে পারে নবায়নযোগ্য শক্তি বায়ুপ্রবাহ, পানির স্রোত, সূর্যের আলো, জৈব-জ্বালানি ইত্যাদি।শহরে প্রধান যানবাহন হিসেবে থাকবে বিদ্যুৎ-চালিত ট্রেন ও বাস। বিদ্যুৎ-চালিত গাড়ি, বিমানপ্রযুক্তিরও যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটবে। আন্তর্জাতিক বেশিরভাগ মালামাল পরিবহন হবে নৌপথে। যেখানে বায়ুশক্তিচালিত জাহাজ চলাচল করবে। এই কারণে প্রচুর নদী ও খাল সৃষ্টি করতে হবে।
সস্তা জীবাশ্ম জ্বালানির কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি হয়নি। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি না থাকলে স্বাভাবিকভাবেই এমন প্রযুক্তির যথেষ্ট উন্নতি দেখা যাবে।
বিশ্বে অনেক স্থানে এখনই সৌরশক্তি ব্যবহার করে রান্না করা হয়। ভবিষ্যতে সৌরশক্তি ব্যবহারের প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলে এটি ব্যবহার করে শিল্প-কারখানাও গড়ে উঠতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১৬ শতাংশই আসে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। পৃথিবীর অনেক স্থানে এখনো জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো যায়।
বাংলাদেশে জ্বালানির মূল উৎস প্রাকৃতিক গ্যাস। এ গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে, সার কারখানায়, বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় এবং গৃহস্থালির কাজে। গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে আসছে দ্রুতগতিতে। এ অবস্থায় গ্যাসের বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে । দেশের বর্তমান মজুদ গ্যাস আরও ১৬ বছর ব্যবহার করা যাবে। একই সময়ের মধ্যে ধীরে ধীরে গ্যাসের সরবরাহও কমে যাবে। জ্বালানি শক্তি হিসেবে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পের জন্য এটি সতর্কতামূলক বার্তা। বিষয়টি বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যও ইঙ্গিতবাহী। প্রথমত সব বিকল্প ব্যবস্থার সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা দরকার। দ্বিতীয়ত নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানের বিষয়টিও বাদ দেয়া যাবে না। তৃতীয়ত গ্যাস ব্যবহারে আরও সাশ্রয়ী হতে হবে।
বিশ্বের জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেক আগে থেকে নানা গবেষণা চালিয়ে আসছেন নিরাপদ বা উত্তম জ্বালানির উৎসের সন্ধানে। তারা অপ্রচলিত কিছু জ্বালানির উৎসের সন্ধানও পেয়েছেন। সৌরশক্তি, বায়োফুয়েল ইত্যাদি এর প্রকৃত উদাহরণ। কয়লা, কেরোসিন, ডিজেল, পেট্রোল ইত্যাদি জ্বালানির উন্নত মাধ্যমে হলেও তা পরিবেশের জন্য কম-বেশি ক্ষতিকর। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে গ্যাস-হাইড্রেট নিয়ে নানা গবেষণা চালাচ্ছেন। তারা বলছেন, সমুদ্রের তলদেশে থাকা এ গ্যাস হাইড্রেট হতে পারে ভবিষ্যত জ্বালানির অন্যতম উৎস। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পৃথিবীতে প্রায় এক হাজার বিলিয়ন টন পরিমাণ গ্যাস হাইড্রেট সঞ্চিত রয়েছে সমুদ্রতলের গভীরে কিংবা মেরু অঞ্চলের পারমাফ্রস্টের মধ্যে। সঙ্গত কারণেই ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে এই বিশাল জ্বালানি সম্পদ। বিকল্প জ্বালানির উৎস হিসেবে সমুদ্রের ওপর আমাদের আশা হারানোর তাই কোন কারণ থাকতে পারে না।
সারা পৃথিবীতেই এখন নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা বা লাতিন আমেরিকার মতো দেশগুলোতে এখনই বেশ বড় আকারে শক্তি উৎপাদনের উৎস হচ্ছে বায়ু প্রবাহ, সৌরশক্তি এবং বায়োগ্যাস। আমাদের দেশে সৌরশক্তির ব্যবহার থাকলেও বায়ু প্রবাহ, বায়োগ্যাস, হাইড্রোজেনসহ অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এ সম্ভাবনার দিকটিও মনে রাখতে হবে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌর শক্তির রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। আশার কথা, সরকার এ ব্যাপারে সচেতন রয়েছে, প্রতিমাসে প্রায় ৮০ হাজার পরিবারের ঘরে সোলার প্যানেল বসছে। জ্বালানির মজুদ কমে আসার ফলে আগামী এক যুগের মধ্যেই আমাদের ব্যাপকভাবে নবায়নযোগ্য ও বিকল্প শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল জীবাশ্ম শক্তির জন্য পরিবেশ ও আর্থসামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ ও মুল্যায়ন সম্পর্কে গুরুত্ব আরোপ করছে। একই সাথে কিভাবে ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির বিকল্প শক্তির উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায় সেই জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
যারা শক্তির জন্য পরিবেশ ও আর্থসামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণ ও মুল্যায়ন সম্পর্কিত গবেষণা প্রস্তাব জমা দিবেন তাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিতে হবে।
শক্তি বিশ্লেষণ
পরিবেশগত বিশ্লেষণ
শক্তি এবং সবুজ পরিবেশ
সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব মূল্যায়ন
বায়ু প্রবাহের গুণমান এবং শক্তি
জলজ সম্পদ এবং শক্তি
স্থলজ সম্পদ এবং শক্তি
শক্তি সম্পর্কিত জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যা