জনসংখ্যা বাড়ছে, জ্বালানি ও শক্তি নির্ভর প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, মানব সভ্যতা অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে। সভ্যতার উন্নতির সাথে সাথে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় বিভিন্ন অ-নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এদের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এই শক্তির উৎসগুলি একদম শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে শক্তি সংকটের সৃষ্টি হবে। তাই এই জ্বালানির প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ্য রেখে এদের সংরক্ষণের প্রয়োজন।
জ্বালানি সংরক্ষণের একটি উপায় হল তাদের অপচয় এড়ানো। সোলার হিটার, সোলার কুকার এবং বায়ু শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করে অর্থাৎ নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করেও অ-নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কমানো সম্ভব। ব্যাক্তিগত ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার কমিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং কারপুল ব্যবহার করে এই প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার কমানো যেতে পারে।
জীবাশ্ম জ্বালানী অ-নবায়নযোগ্য সম্পদ। একবার ব্যবহার করলে আর কখনও পুনঃস্থাপিত হয় না। প্রতিস্থাপন করতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগে যায়। জীবাশ্ম জ্বালানী সমূহ আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এগুলি ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না। তাই এগুলো সংরক্ষণ করে রাখা প্রয়োজন যাতে দ্রুত শেষ হয়ে না যায়, যাতে পরবর্তী প্রজন্মকে জ্বালানি হ্রাসের পরিণতি ভোগ করতে না হয়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব হ্রাস করে, তেল নির্ভরতা খরচ হ্রাস করে, শক্তির স্থায়িত্ব বাড়ায় এবং অর্থ সাশ্রয় করে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমাতে হবে কারণ এগুলো শক্তির অ-নবায়নযোগ্য উৎস। একবার নিঃশেষ হয়ে গেলে সহজে আর পাওয়া যাবে না। পুনরায় পূরণ করতে হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে। সুতরাং শক্তির বিকল্প উৎসসমূহের সন্ধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জ্বালানি সংরক্ষণ বলতে আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণকেই বোঝায়। বায়োগ্যাস এবং সৌর শক্তি ব্যবহার করে খাবার রান্না করা জ্বালানি সংরক্ষণ করার একটি চমৎকার উপায়। সৌর শক্তি সীমাহীন এবং কোনো দূষণ সৃষ্টি করে না। এই শক্তিকেই জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করতে হবে। সর্বত্র নবায়ন যোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করে ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে ফেলতে হবে। এতে পরিবেশ দুষণ মুক্ত হবে, প্রকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে।
জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে কয়লার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। কয়লা একটি জৈব পদার্থ। পৃথিবীতে একসময় অনেক গাছপালা ছিল। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ও প্রাকৃতিক পরিবর্তনে সেই সব গাছপালা মাটির নিচে চাপা পড়ে যায় এবং জমতে থাকে। গাছের পাতা ও কাণ্ড রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে কয়লায় পরিণত হয়। ভারতবর্ষে কয়লার ব্যবহার শুরু করে ১৭৭৪ সালে। ট্রেন ও জাহাজে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হয়। কলকারখানায় লোহা ও ইস্পাত তৈরিতে কয়লা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে কয়লা পুড়িয়ে মূলত বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।
প্রাকৃতিক গ্যাস শক্তির একটি অতি পরিচিত উৎস। প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায় ভূগর্ভে। পৃথিবীর অভ্যন্তরের প্রচন্ড চাপ ও তাপ এই উপাদান সৃষ্টির প্রধান কারণ। পেট্রোলিয়াম কূপ থেকেও প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়। এই গ্যাসের প্রধান উপাদান মিথেন। প্রাকৃতিক গ্যাসের শতকরা ৬০-৯৫ ভাগ হল মিথেন।
পেট্রোলিয়াম একটি ল্যাটিন শব্দ। এই শব্দটি এসেছে দুটি ল্যাটিন শব্দ পেট্রো ও অলিয়াম মিলে। 'পেট্রো' অর্থ পাথর ও 'অলিয়াম' শব্দের অর্থ তেল। অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম শব্দের অর্থ পাথরের তেল । টারশিয়ারি যুগে অর্থাৎ আজ থেকে ৫-৬ কোটি বছর পূর্বে পাথরের স্তরে স্তরে গাছপালা ও সামুদ্রিক প্রাণী জমা পড়ে। কালে কালে তারাই খনিজ তেলে পরিণত হয়। আজকের স্থলভাগের অনেকটাই পূর্বে সমুদ্রের অন্তর্গত ছিল।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান উপাদান কয়লা। কয়লা পুড়িয়ে সরাসরি তাপ পাওয়া যায়। এটি একটি অতি পরিচিত জ্বালানি। তবে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও এর আরো নানা ব্যবহার রয়েছে। কয়লা থেকে অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান পাওয়া যায়। এদের মধ্যে রয়েছে কোলগ্যাস, আলকাতরা, বেনজিন, অ্যামোনিয়া, টলুয়িন প্রভৃতি। রান্না করতে ও বাষ্পীয় ইঞ্জিন চালাতে ব্যবহৃত হয় কয়লা। একসময় কয়লা জল পরিশোধনের জন্য ব্যবহৃত হতো।
প্রাকৃতিক গ্যাস একসময় একটি অপ্রয়োজনীয় পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত হতো যা পেট্রোলিয়ামের সাথে উৎপাদিত হতো। তবে বর্তমানে এটি একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদার্থ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার খুবই ব্যাপক। এর প্রধান ব্যবহার জ্বালানি হিসেবে। রান্নার কাজে এর ব্যবহার রয়েছে। তবে সিলিন্ডারে করে যে গ্যাস সরবরাহ করা হয় তা প্রধানত বিউটেন। অনেক সার কারখানায় এর ব্যবহার রয়েছে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রেও এর ব্যবহার রয়েছে।
শক্তির অন্যতম পরিচিত উৎস খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম। বর্তমান সভ্যতায় এর ব্যবহার অনেক ব্যাপক। গ্রামের কুঁড়েঘর থেকে শুরু করে আধুনিক সভ্যতার পরিবহন ব্যবস্থায়-সর্বত্রই এর অবদান রয়েছে। পেট্রোলিয়াম থেকে নিষ্কাশিত তেল পেট্রোল। পাকা রাস্তার ওপর দেয়া পিচ, কেরোসিন ও চাষবাসের জন্য এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। তবে এর প্রধান ব্যবহার জ্বালানি হিসেবে। পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যের প্রধান ব্যবহার তড়িৎ ও যান্ত্রিক শক্তির উৎপাদনে।
এইসব জীবাশ্ম জ্বালানিসমূহ সবই হাইড্রোকার্বন, এগুলোর কেবল দুটি উপাদান, কার্বন এবং হাইড্রোজেন। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয় শক্তি উৎপাদন করতে। বাড়িতে এগুলিকে তাপ উৎপাদন করতে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বিকল্প নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি, ব্যাটারি শক্তির উন্নয়ন ও ব্যবহার বৃদ্ধি এবং ব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তির অপচয় রোধ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি শক্তিকে সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।
কীভাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি শক্তি সাশ্রয় করা যায়? কিভাবে জ্বালানি খরচ কমানো যায়?
জ্বালানি খরচ হ্রাস প্রক্রিয়া
বিদ্যুতের খরচ হ্রাস প্রক্রিয়া
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ শক্তি জনিত ব্যয় হ্রাস করার পাশাপাশি শক্তি সংরক্ষণের প্রযুক্তি, কৌশল ও যন্ত্রপাতি সমূহ আপগ্রেড করতে হবে। শক্তি সংরক্ষণের জন্য নতুন উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বাধিক ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তি, কৌশল ও সরঞ্জামাদির বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
ভোল্টেজ এবং ফ্রিকোয়েন্সি ওঠানামার ক্ষেত্রে গ্রীডকে স্থিতিশীল করতে শক্তি সঞ্চয়ের ডিভাইসগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। গ্রিডে ক্রমবর্ধমান পরিমাণে সৌর বিদ্যুৎ এবং বায়ু বিদ্যুৎ সরবরাহে শক্তি সঞ্চয়ের ডিভাইসগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। কেননা এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম, ডিস্ট্রিবিঊশন সিস্টেম ও নেট মিটারিং সিস্টেমকে একত্রিভূত করে চলমান পাওয়ার সিস্টেমের নির্ভরযোগ্যতা বাড়ানো যেতে পারে। Pump Storage System, Thermochemical Storage System, Thermal Energy Storage System, Electrochemical Energy Storage System, Flywheel Energy Storage System, Compressed air energy storage System ইত্যাদি শক্তি সঞ্চয়ের ডিভাইসসমুহের আপডেট করে এদের বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও জ্বালানি শক্তি সংরক্ষণে অগ্রগতি সাধনের জন্য প্রায়োগিক গবেষণা ভিত্তিক প্রকল্পে অর্থায়ন করছে। এতে জ্বালানি শক্তি সংরক্ষণের নিমিত্ত জ্বালানি দক্ষ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়বে,বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে সচেতনতা বাড়বে, জ্বালানি খাতে ব্যয় কমবে, অপচয় রোধ হবে।
আবাসিক, বানিজ্যিক ও শিল্পখাত সহ সকল খাতে শক্তি সংরক্ষণে প্রযুক্তির বিকাশ, জ্বালানি দক্ষ যন্ত্রপাতির আপডেট, শক্তি পরিষেবা ব্যবহারে সাশ্রয়ী আচরণ,পরিবেশের উপর প্রভাব ও আর্থিক বিষয় বিবেচনায় রেখে উক্ত খাতে বিভিন্ন গবেষণা মুলক প্রকল্পে নির্ধারিত নীতিমালার ভিত্তিতে অর্থায়ন করা হচ্ছে।
প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে শক্তির অপচয় রোধ হবে, প্রযুক্তির বিকাশ ঘটবে, জীবন যাপনের মান বৃদ্ধি পাবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বাড়বে ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উন্নত জীবন ব্যবস্থা নিশ্চিত হবে।
যারা শক্তি সংরক্ষণের নিমিত্ত প্রায়োগিক গবেষণা প্রস্তাব জমা দিবেন তাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ বিবেচনায় নিতে হবে।